দূর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভয়ারণ্য নোবিপ্রবি’র “প্রযুক্তি রোড”!

মাহতাব চৌধুরী, নোবিপ্রবি প্রতিনিধিঃ

নোয়াখালী সদর পৌরসভার অন্যতম ব্যস্ত সড়ক সোনাপুর জিরো পয়েন্ট। যেখানে রয়েছে সোনাপুর -লক্ষ্মীপুর সড়কের পাশাপাশি প্রযুক্তি রোডকে কেন্দ্র করে চৌরাস্তার মোড়।

দেশের অন্যতম সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় “নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে” আসা-যাওয়া করার একমাত্র পথ ‘প্রযুক্তি রোড’ এই চৌরাস্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোড।

কিন্তু প্রতিদিনই নানা অব্যস্থাপণার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতকারী শিক্ষক -শিক্ষার্থী অসহনীয় যানজটের কারণে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হন।

প্রযুক্তি রোডে যে যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষদেরঃ

১. রাস্তার বেহাল দশা, ভাঙা রাস্তা, উঁচু-নিচু।
২. রাস্তা খুবই সংকীর্ণ।
৩. অবৈধভাবে স্থাপিত ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান ও ফুটপাত দখল।
৪. রাস্তার পাশে বেড়ে উঠা গাছের ঢালপালা, যা বাস, বাসের চালক ও শিক্ষার্থীর যেকোনো বড় দূর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
৫. রাস্তায় তীব্র যানজট, যার কারণে সময় নষ্ট হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর।
৬. চাঁদা আদায়ের কারণে গাড়ির চালকরা শিক্ষার্থীদের থেকে নায্য ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে।
৭. খাল অব্যস্থাপনা।

এই সড়কটিতে যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, অবৈধভাবে ফুটপাত দখল। ফুটপাত দখল করে স্থাপিত হয়েছেঃ

১. সিএনজি স্ট্যান্ড
২. অটোরিক্সা স্ট্যান্ড
৩. হকার
৪. টং
৫. মাছ বাজার
৬. বিভিন্ন ফলের দোকান
৭. ময়লার ভাগাড় ইত্যাদি

এটি সরকারী খাস সম্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে এই স্থাপনা সৃষ্টি হয়েছে?! অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসলো চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। চরম পর্যায়ের প্রশাসনিক অব্যবস্থপনা, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক প্রভাব এই দখলদারিত্বের প্রধান কারণ।

জানা যায়, জেলা শ্রমিকলীগের নেতা ❝সিএনজি কামাল❞ এর অবৈধ আধিপত্যের কথা। তিনি এই এলাকায় গড়ে তুলেছেন দূর্নীতির ত্রাস।

তার করা দূর্নীতির কিছু ফিরিস্তি তুলে ধরার চেষ্টা করলামঃ
১. প্রত্যেক সিএনজি বাবদ দৈনিক ৬০৳ চাঁদা বাধ্যতামূলক
২. প্রত্যেক রিক্সা বাবদ দৈনিক ৪০৳ চাঁদা বাধ্যতামূলক
৩. প্রত্যেক টং দোকান থেকে দৈনিক ৫০৳ চাঁদা
৪. প্রত্যেক ফল দোকান, হকার, পান বিক্রেতা, মাছের পিক-আপ গাড়ি বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা আদায় করা হতো।

৫. চাঁদা প্রদান না করলে তার ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং দ্বারা চাঁদা আদায়ে বাধ্য করা হতো।

আমরা নোয়াখালীর মাননীয় জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান স্যারের সাথে কথা বললে, তিনি আমাদের জানান যে, এই সড়কটির অবৈধ দখলদারিত্ব পূর্বেও উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তিনি এই ফুটপাত দখলকে আবারো উচ্ছে করার ব্যাপারে আমাদের আবারো পদক্ষেপ নিবেন এবং এই ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করতে চান ও এই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। তিনি অবৈধ বাস স্ট্যান্ডও সরানোর কথা জানান।

এছাড়াও খোকন নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধেও অভিযোগ দিয়েছেন এক টং দোকানদার। এক সিএনজি চালাকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, সিএনজি কামালের মাসিক চাঁদা আদায়ের পরিমাণ ২০ লক্ষ টাকারও বেশি হতে পারে। আরেক ফল দোকানদার বলেন, সিএনজি কামাল গত কুরাবানী ঈদে ফুটপাতে সকল দোকানদার থেকে ৬৮০০০৳ চাঁদা আদায় করে।

এ ব্যাপারে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোঃ নাসিম উদ্দিন সুনামের সাথে কথা বললে তিনি আমাদের জানান, এই ফুটপাত সরকারী সম্পত্তি এবং যারা এই ফুটপাত দখল করে সিএনজি স্ট্যান্ড, দোকানপাট বসিয়েছে তারা অবৈধভাবে করেছে। তিনি সিএনজি কামালের চাঁদা আদায়ের কথা অকপটে স্বীকার করেন এবং স্থানীয় ছেলেরদেরও চাঁদা আদায়ের কথা বলেন। তিনি এও বলেন এইসব অবৈধ দোকানপাট ও স্ট্যান্ড অনেক বছর আগে থেকে চলে আসছে। তার ভাষ্যমতে তারা একবার উচ্ছেদ করলেও পরবর্তীতে আবারও দখল হয় এই জায়গাটি। তিনি ছাত্রদের দাবির সাথে একমত এবং তিনি চান এটির দ্রুত সমাধান হোক।

এছাড়াও আমরা পৌরসভার মেয়র শহীদুল্লাহ খান সোহেলের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তার নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়।

আর এই সিএনজি কামাল-কে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতো স্থানীয় আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতারা। জানা যায় তার সাথে তৎকালীন এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর সখ্যতা থাকায় তার দূর্নীতি বেড়ে উঠেছে।

কিন্তু সরকার পতনের পর সিএনজি কামাল আর চাঁদা আদায় করতে আসেনি। বিগত ৪ তারিখের পর এখন পর্যন্ত চাঁদা আদায় করতে আসেনি কেউই।

এত বড় দূর্নীতি এই সড়কে অথচ স্থানীয় প্রশাসনের এই নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। এইসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণের কোনো উদ্যোগও আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।

এই ব্যাপারে আমরা নোবিপ্রবি’র বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্বাস আলী সাইফুলের সাথে কথা বললে তিনি জানান, “নোবিপ্রবি’র প্রধান সড়ক প্রযুক্তি রোড। কিন্তু এটি আমাদের ছাত্রদের জন্য অত্যন্ত দূঃখের বিষয় যে, এই ৪ কিলোমিটারের একটি সড়কের একাংশে এত বড় দূর্নীতিঃ ফুটপাত দখল, সিএনজি স্ট্যান্ড, রিক্সা স্ট্যান্ড, হকার। এছাড়াও অবকাঠামোগত অবস্থা খুবই শোচনীয়, ভাঙা রাস্তা, উঁচু-নিচু, রাস্তার মাঝে গর্ত, রাস্তার পাশে বড় বড় গাছগুলো বিস্তীর্ণ ঢালপালা, রাস্তার পাশে ময়লার স্তুপ, পরিচর্যাহীন খাল, খালে ময়লার জট ইত্যাদি। যা বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক। আমরা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সকলে এর ব্যাপারে জেলা প্রশাসক, এসপি ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিবো এবং যতদ্রুত সম্ভব এর সমাধান চাইবো। এ ব্যাপারে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সহযোগীতা কামনা করছি।”

সিএনজি ও অটোরিকশা রাখার নির্দিষ্ট স্থান থাকা সত্ত্বেও কোন নিয়মের তোয়াক্কা না করে ‘প্রযুক্তি রোডের’ প্রবেশ পথে যত্রতত্রভাবে ফেলে রাখে।যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গামী ডাবল ডেকার বাসগুলো আটকা পড়ছে এবং নির্দিষ্ট সময়ে ক্যাম্পাসে পৌছুতে পারছেনা।

লক্ষণীয় বিষয় এই যে, দুর্বল ও ভাঙ্গাচোরা রাস্তার পাশটিতে রয়েছে খাল এবং এই খাল থেকে নোংরা উটকো গন্ধ ভেসে আসতে থাকে সবসময়। এই বিষয়টি নিয়েও শিক্ষার্থীরা আতংকিত থাকে কখন জানি কোন দূর্ঘটনা ঘটে নর্দমায় বাস পড়ে যায়।

এছাড়াও সাম্প্রতিক, NSTU ALL DEPARTMENTS && ALL BATCHES এ পোল ভোটের মাধ্যমে এই সড়কের সংস্কারের ব্যাপারে মতামত জানতে চাওয়া হলে শতভাগ ভোট পড়ে দ্রুত সংস্কার ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ- এর পক্ষে।

এ ব্যাপারে, নোবিপ্রবির ১৫ ব্যাচের পরিসংখ্যান ব্যাচের শিক্ষার্থী তৌসিফ আহমেদ মহিম বলেন, “নোয়াখালী জেলার ব্র্যান্ডিংয়ের অন্যতম উপায় হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বর্ধন করা। এটির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কের অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ নোয়াখালীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। কারণ এই ভার্সিটিতে দেশের সব জেলার ছাত্রছাত্রীরা অধ্যয়ন করে। তাদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করাও আমাদের দায়িত্ব। এটি শুধুমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমেই সম্ভব। আশাকরি আমরা অতিশীঘ্রই এই সড়ক সংস্কারসহ, ফুটপাত দখলমুক্ত হিসেবে দেখতে পাবো।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী সহ সাধারণ মানুষের একই দাবী, সোনাপুর জিরো পয়েন্ট সহ ‘প্রযুক্তি রোডের’ সংকট নিরসনে যেন কর্তৃপক্ষ অতিসত্বর পদক্ষেপ নেয়।
নাহয় শহরের সৌন্দর্য নষ্টের পাশাপাশি প্রযুক্তি রোডে যাতায়াত করার দুর্ভোগ আরও ঘণিভূত হবে।

Leave a comment

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Translate »